ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করি। সুপার মার্কেটে ঢুকেছি কিছু কেনাকাটা করব বলে। হঠাৎ কানে এল-মাইশা মাইশা হুয়ার ইউ? খামন…খামন। আমি পেছন ফিরে তাকাই। দেখি ৩-৪ বছরের পুতুলের মতো একটা মেয়ে, দৌড়ে লোকটার কাছে এসে বলল, আই এম হেয়ার ডেডি!
বাবা তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ডোন্ট গো ফারউয়ে! লোকটার উচ্চারণ ছিল বেশ হাস্যকর, যদিও আমার ইংরেজি উচ্চারণ এর চাইতে তেমন একটা ভালো নয়। তার পরও আমার হাসি পাচ্ছিল! একটু কৌতহল হলো, ভাবলাম কথা বলি। জানা গেল তিনি আমাদের এলাকার লোক। জিজ্ঞেস করলাম, মেয়ে কি বাংলা বোঝে না? কেন বুঝবে না? আমরা বাঙালি না! তাহলে নিশ্চয়ই ওর মা ইংলিশ! আমি ঠাট্টার ছল করি। কী যা-তা বলছেন, ভাই! তিনি আমাকে কপট ধমক দেন। তাহলে ওর সঙ্গে ওর মায়ের ভাষায় কথা বলছেন না কেন? আমি প্রশ্ন করি।
তিনি বোধ করি এ ধরনের উদ্ভট প্রশ্নের সম্মুখীন হননি কখনো! বললেন, বাংলা শিখে কী হবে ইংরেজের দেশে? আমার মেয়ে সামনের বছর স্কুলে যাবে, স্কুলে তো বাংলা চলবে না। ও বাংলা পারে, এখন আর বাংলার দরকার নাই!
আমি বললাম, তা ঠিক। তবে ওর সঙ্গে বাংলায় কথা বলার চর্চা করলে কোনো সমস্যা হবে বলে তো আমি মনে করি না। স্কুলে এরা ঠিকই ইংরেজি বলবে, কোনো সমস্যা হবে না। বাংলাটা চালু রাখুন, প্লিজ! আমার এসব আবেগপ্রবণ কথায় উনি পাত্তা দেননি। আমার বিশ্বাস, এই মেয়ে আর কোনো দিনই তার মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে না।
এবার আসি নিজের অভিজ্ঞতায়। আমার ছেলের এ দেশে জন্ম। দেখতে দেখতে কখন যে তার প্রি-কেতে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি! স্কুলে আড়াই ঘণ্টার ক্লাস। আমি এবং আমার স্ত্রী পড়েছি ভীষণ দুশ্চিন্তায়। কারণ সে একটি শব্দও ইংরেজি বলতে পারে না, আমরা কোনো দিন ওর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলিনি কিংবা আমার হাইস্কুলে পড়ুয়া মেয়েও! প্রথম দিন স্কুলে তাকে নিয়ে রেখে আসতে পারছিলাম না, সে কী কান্না! তার কান্না দেখে আমার স্ত্রীরও কাঁদার উপক্রম! তখন টিচার এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমরা সামনে থেকে চলে যাও, এসবে আমরা অভ্যস্ত! জানি কী করতে হবে।
তার পরও আমরা বাসায় না গিয়ে স্কুলের আশপাশে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাচ্ছিলাম। যদি কখনো ওরা আমাদের কল করে! ওর যদি বাথরুমে যাবার দরকার হয়, তাহলে কি টিচারকে বলতে পারবে? অনেক বড় রকম ভুল করেছি ওকে ইংরেজিটা না শিখিয়ে! টিচারকেই-বা কোন মুখে বলি ২০ বছর ধরে এ দেশে, ছেলের জন্মও এ দেশে আর এ দেশের ভাষা জানে না! না না আর ভাবা যাচ্ছে না, যেভাবেই হোক টিচারকে বলতে হবে এবং ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে!
দ্বিতীয় দিন কিছুটা মন খারাপ থাকলেও ও কান্নাকাটি করেনি। তৃতীয় দিন সে আমাদের বলে, তোমরা বাসায় চলে যাও। টিচাররা তোমাদের থাকতে দেবে না, ‘এলাউড’ না! আমি ঠিক আছি! একেবারে পাকামো কথাবার্তা! আমরা দুজন আশ্চর্য! একদিন এ বিষয়ে যখন টিচারকে বলতে যাই, তখন টিচার যেন আকাশ থেকে পড়ল! বলে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, তোমরা কী বলতে চাও? ও তো সবই বুঝে এবং ইতিমধ্যে সে অনেক বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে!
তার প্রমাণ পেলাম কয়েক দিন পর। তাকে আনতে গিয়েছি, দেখি সে টিচারের সঙ্গে হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বলছে! টিচার বারবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।
ঘটনা হলো, আজ তাদের খেলাধুলার কোনো স্ক্যাজুয়াল ছিল না, তাই সে বারবার টিচারকে জিজ্ঞেস করছিল আজকে কেন তাকে খেলতে দেওয়া হলো না?
আমরা দুজনই বেশ স্বস্তিবোধ করি, যাক আমার ছেলে ইংরেজি বলতে পারে! সে বাসায় কার্টুন দেখত। এই কার্টুনই তাকে ইংরেজি কথাবার্তা বলতে সাহায্য করেছে এবং সেই সঙ্গে স্কুলের শিক্ষাদান পদ্ধতির সুফল বলে ধরে নিই। এরপর ছেলের জন্য ভাষাগত সমস্যার কথা কল্পনায়ও আসেনি! আমার ছেলের ভাষা এখন ইংলিশ ও বাংলা দুটোই।
আমাদের প্রতিবেশী একটি পরিবারের তৃতীয় সন্তান, ফুটফুটে অসম্ভব সুন্দর তিন বছরের মেয়ে, কথা বলতে পারে না, তবে ‘উ-আ’ শব্দ করে। মা যখন নাম ধরে ডাকে দৌড়ে আসে। ‘সিট’ বললে বসে। ‘ইট’ বললে খায়। সারা দিন ধ্যান ধরে টিভি দেখে। তার এক ভাই ও এক বোন ওর সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলে এবং ও নাকি ‘রেসপন্ড’ করে, তবে কথা বলে না! বাবা-মা দুজনই চিন্তিত। ইতিমধ্যে বাসায় ‘স্পিচ থেরাপিস্ট’ এসে চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো উন্নতি হচ্ছে না! ডাক্তার একদিন প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, মেয়ের মায়ের মুখের ভাষা বাংলা এবং তিনি মেয়ের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করেন। তখন ডাক্তার ব্যাখ্যা দিলেন, তার জন্য তারা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না! একটা শিশুর কণ্ঠ নাকি আগে ফুটতে হবে, সেই ফোটা সম্ভব সবচাইতে কাছের মানুষ মায়ের মুখের ভাষার মাধ্যমে। মা সারা দিন কথা বলবেন, ছড়া-গল্প বলবেন, খুনসুটি করবেন, শিশু আনন্দ নিয়েই স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে তা আয়ত্ত করবে, যদি-না অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে। মাতৃভাষা হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামত, যেভাবে বলা হয় মায়ের বুকের দুধ।
ডাক্তার তাদের পরামর্শ দিলেন দেশ থেকে বেড়িয়ে আসতে। সেই পরিবার সামারে দুই মাসের জন্য দেশে বেড়াতে গেল। দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-ফুফু, কাজিন ভাইবোনদের সঙ্গে মিশে কখন যে মেয়ের মুখে কথা ফুটল কেউ টেরই পাননি!
দুই মাস পর ও যখন আমেরিকায় ফিরে এল, তখন যেন তার মুখে খই ফোটে! এখন সে বাংলা-ইংলিশ দুই ভাষাই বুঝে এবং বলতে পারে। এমন অনেক উদাহরণ আরো আছে বলে আমার বিশ্বাস! তবে তার এই বাংলা ভাষাটা ধরে রাখতে হলে ঘরে বাংলা বলার চর্চাটা রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।
এই প্রবাসে আমরা বাঙালিরা স্বদেশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে কত কিছুই না করছি অহরহ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, সংস্কৃতি তথা বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বহমান রাখতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে। এসব অনুষ্ঠানে আমাদের প্রজন্মদের অংশগ্রহণ কতটুকু স্বতঃস্ফ‚র্ত, তা দেখার প্রয়োজন আছে। যদি তাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় না থাকে এবং একটি শব্দও বাংলায় বলতে না পারে, তাহলে তাদের কাছে এসব মেলা, দিবস বিরক্তিকর বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়! অনেকে প্রজন্মদের জন্য অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন বিভিন্ন দিবসে। বিশেষ করে বাংলাচর্চা-বিষয়ক। কিছু কিছু পরিবারের সন্তানেরা অভাবনীয় রকম প্রদর্শন করলেও বেশির ভাগই দেখা যায় শুধু মঞ্চে ওঠা এবং পরের দিন তা পত্রিকার পাতায় খবর ও ছবি ছাপানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ!
একটি বাস্তব উদাহরণ দিই। কোনো এক পিঠা উৎসবের ঘটনা, দুই মহিলা একেবারে বাঙালি সাজে উৎসবে বসে কথা বলছিলেন। কথাগুলো বেশ উঁচু স্বরে বলে সবাই শুনতে পাচ্ছিলেন এবং তাদের মাঝে কোনো জড়তা ছিল না। একজন আরেকজনকে তার বাচ্চারা কোথায় জানতে চাইলে, উত্তরে অন্যজন বললেন, তাদের কোনোক্রমেই আনা সম্ভব নয়, বাসায় ‘কম্পিউটার’ নিয়ে ব্যস্ত! এসব অনুষ্ঠান নাকি ‘বোরিং!’
অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে ছিল ‘পোশাকে বাঙালি সাজো’ নামে প্রতিযোগিতা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চমৎকার সেজেছে! গাঁয়ের বধূ, রাখাল ছেলে, কৃষক, বাউল মোটামুটি চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্যের সবকিছু মঞ্চ আলোকিত করছিল! খুব ভালো লাগছিল। খারাপ লাগল তখনই, যখন দেখলাম তাদের বিভিন্ন মজার প্রশ্ন করা হচ্ছে, কিন্তু তারা কোনো উত্তর দিচ্ছে না, এমনকি তাদের নাম জিজ্ঞেস করলে তাতেও তারা আমতা আমতা করছে! দেখে-শুনে মনে হচ্ছিল, ওরা যেন বোবা!
আসল ঘটনা হচ্ছে, উপস্থাপিকা ওদের বাংলায় প্রশ্ন করছিলেন। একসময় তা বুঝতে পেরে যখন ইংরজিতে প্রশ্ন করলেন, তখন তাদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিল। বেশ আহত হলাম এতে!
আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি, এ উৎসব আসলে কাদের জন্য? আমাদের বুড়োদের জন্য? বাংলাই যখন ওরা বলতে পারে না, মাতৃভাষাই বোঝে না, তাদের আমরা বাংলা সংস্কৃতির কতটুকু ধারণাই-বা দিতে পারব?
নিউ ইয়র্কে প্রতিবছর বইমেলা হয়। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে এই প্রবাসে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এই উদ্যোগ যদি নেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা নিঃসন্দেহে মহৎ। এই মহতী কাজের সূচনা করেছিল মুক্তধারা, যার অগ্রযাত্রা এখনো অব্যাহত। বইমেলা এখন নিউ ইয়র্কে বৃহত্তম সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে এবং নাম দেওয়া হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব।’ দেশীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে, তথা শিকড়ের টানে সব সময় চেষ্টা করি সপরিবারে এ ধরনের মেলায় উপস্থিত থাকার। আগে থেকেই ছুটি নিয়ে রাখি, বিশেষ করে বইমেলার জন্য।
ঠিক এ রকম একটি মেলার অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলাম এক অডিটরিয়ামে। পর্বটা ছিল একক লোকসংগীত। প্রবাসের নামকরা একজন লোকসংগীতশিল্পী, প্রবাসে বাংলা মায়ের শিকড়সন্ধানী এ শিল্পীর একটি স্কুলও আছে এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলার সুর ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন নিরন্তর! পত্রিকার বিজ্ঞাপনেও তার এ প্রত্যয়ের কথা বলা থাকে। তিনি গান শুরুর আগে এ দেশে মিউজিকের ওপর স্নাতক ডিগ্রিধারী তার মেয়েকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, তার মেয়ে আমাদের কিছু গান গেয়ে শোনাবে। যোগ্য পিতার সুযোগ্যা কন্যার গান শোনার জন্য সবাই উদ্্গ্রীব। পরিচয় পর্বে প্রথমেই মেয়েটি সবিনয়ে ক্ষমা চাইল যে সে বাংলাটা ঠিকমতো বলতে পারবে না! সবাই একটু ধাক্কার মতো খেলাম! তবে মনে মনে বললাম, অসুবিধা নেই, গান গাইতে পারলেই হলো। চমৎকার সুন্দর একটি ইংরেজি গান গাইল। তার অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠের কারুকাজ সবাইকে চমকে দিল! ভাবলাম, এবার হয়তো সে বাংলায় গাইবে!!! না, পরপর চারটি গান সে ইংরেজিতে গেয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল! তারপর তার বাবা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বেশ অহংকারের সঙ্গে বললেন, এরপর কি আমার গান গাওয়ার সাহস থাকে!
প্রবাসে বাংলা পল্লিগানের শিকড়সন্ধানী সেই ‘যোগ্য’ পিতার ‘সুযোগ্যা’ কন্যার কণ্ঠ থেকে কি একটি বাংলা গানের লাইনও আশা করতে পারি না? এ ধরনের ‘হিপোক্রেসিকে’ কীভাবে ব্যাখ্যা করব? আমি ক্ষোভে-দুঃখে আমার পরিবারসহ অনুষ্ঠানস্থল থেকে বের হয়ে আসি, ওনার গান আর শোনার ইচ্ছা হয়নি!
শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় নিউ ইয়র্ক বাংলাদেশের চেয়ে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই, তা হলফ করে বলা যায়। প্রচুর লেখক-কবি-সাহিত্যিকের সরব ক্রিয়াকলাপ আমাকে মুগ্ধ করে, অনুপ্রাণিত করে। ঠিক এ রকম একজন লেখকের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় ও বন্ধুত্ব। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যে তার স্পর্শে আলোকিত হয়নি। তার ৫০তম জন্মদিনে আমাদের দাওয়াত করেন। আমি সপরিবারে উপস্থিত হই। সেখানে তার বর্ণাঢ্য সচিত্র বায়োগ্রাফি ধারাবর্ণনাসহ উপস্থাপন করা হয়। তারপর লেখক নিজে তার বিশ্ববিদ্যালয়-পড়–য়া ছেলেকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করেন। ছেলের সাজপোশাক মোটামুটি বাঙালি চেতনার পরিচায়ক ছিল। সমস্যা হলো তার বক্তৃতায়, সে যখন বলল, ‘মাই আব্বু ইজ এ গ্রেট রাইটার, আই এম প্রাউড অফ হিম!’ তখন হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারলাম না! উপস্থিত একজন বাচিক শিল্পী আমার কানের কাছ এসে বললেন, ভাই, এটা কী হলো! সারা জীবন বাংলা কপচাল, আর নিজের ছেলেই বাংলা বলতে পারে না! আমি বললাম, প্রবাসে এটাই বেশি হচ্ছে।
প্রবাসের কর্মব্যস্ততার মধ্যে শুধু নিজের পরিবারকেই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ থাকে বা করি। আমার সন্তানেরা কীভাবে বড় হচ্ছে? তারা কি আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে? আমাদের মধ্যে কেবলই এসব চিন্তা কাজ করে। তাই হয়তো আমি তাদের যতটুকু পারি সময় দেওয়ার চেষ্টা করি। এ ক্ষেত্রে একজন মায়ের ভ‚মিকা প্রধান। আমার দুই সন্তান বাংলায় কথা বলে। ওরা ভুলেও বাবা-মায়ের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে না। যদিও তাদের চারপাশের ভাষা ইংরেজি। তার মানে এই নয় যে এটা তাদের ওপর আরোপিত, বরং বলা যায় স্বতঃপ্রণোদিত। আমরা যা করেছি তা হলো, ঘরের পরিবেশ, খাওয়াদাওয়া, ওঠা-বসা, পরিধেয়Ñসবকিছুতেই আমরা বাঙালি। ওরা যা কিছু শিখছে তা স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে, আনন্দের সঙ্গে। জানি না কতটুকু পারব, তার পরও চেষ্টার ত্রটি করছি না, তাদের আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করছি নিরন্তর।
অভিবাসীর এ দেশে আমার সন্তানেরা তাদের স্কুলে বেশ ভালোই করছে, এ ক্ষেত্রে বাংলা তাদের কোনো সমস্যা করছে না বরং তারা এ জন্য গর্ববোধ করে। মেয়েটি তো স্কুলে ইংরেজিতে বক্তৃতা ও কবিতা লেখার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে! প্রিন্সিপাল তাকে অনুষ্ঠান উপস্থাপিকা হিসেবে মনোনীত করেছেন, কই বাংলা তো তার জন্য কোনো সমস্যা করেনি!
বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির এ দেশে পৃথিবীর নানা অঞ্চল থেকে লোকজন আসে অভিবাসী হয়ে। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করে যায় প্রতিনিয়ত। তার প্রমাণ, আমরা দেখি প্রতি মাসেই কোনো না কোনো দেশের ‘প্যারেড’, যার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় তাদের দেশকে, সেই সঙ্গে বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রাম। প্রত্যেকে একে অপরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করে। নিজেকে উপস্থাপন করার উপযুক্ত স্থান হচ্ছে এই দেশ। তবে আমরা বাঙালিরাই-বা কেন গুটিয়ে থাকব?
একটি উদাহরণ দিই সামারে আমরা বেশ আয়েশ করে দেশীয় পোশাক-আশাক পরে ছুটির দিনে বেড়াতে বের হই। প্রায় সময়ই একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। সাধারণত বিকেলবেলা ‘রাশ আওয়ারে’ ট্রেনভর্তি লোকজন থাকে। আমি আমার পরিবারকে নিয়ে কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে আছি, দেখা গেল কেউ একজন উঠে আমার স্ত্রীকে বসার জায়গা করে দিচ্ছে। তখন আমরা বেশ বিব্রতবোধ করি এ কারণে যে এত লোক থাকতে অন্য কাউকে না বলে আমার স্ত্রীকে বলছে কেন? এ ক্ষেত্রে আমার স্ত্রী অত্যন্ত নমনীয়ভাবে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমি ঠিক আছি! অনেকে আমাদের পোশাক দেখে বেশ প্রশংসা করে! মনে হয় যেন আমরা তাদের কাছে মেহমান, বেড়াতে এসেছি!
আমার মেয়েকে প্রশ্ন করি, এত লোক থাকতে তোমাদের বসতে বলে কেন? মেয়ের সোজাসাপ্টা উত্তর আমরা দেখতে ভদ্র, এ জন্য!
ভদ্র? তোমার আম্মুর কাঁচুমাচু মুখ দেখে তা-ই মনে হয়? আমি তাকে প্রশ্ন করি। তখন সে উত্তর বদলে বলে-আমরা বাঙালি, এ জন্য।
তাই তো! আমরা বাঙালি, আমরা ভদ্র, এটাই আমাদের অহংকার! ওই লোকগুলো হয়তো জানে, আমাদের ঐতিহ্য হচ্ছে নারীদের শ্রদ্ধা করা। তারা ইতিমধ্যে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক আচার-ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পেয়ে গেছে। তাদের এ শ্রদ্ধাবোধ কেন নষ্ট করব উদ্ভট সব আচরণ করে? বরং আমাদের উচিত হবে নিজেদের একেবারে খাঁটি বাঙালি হিসেবে উপস্থাপন করা এবং এটিই আমাদের অহংকার হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে মাতৃভাষার চর্চা। একটি দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ভালো পরিচিতি লাভ করার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে সে দেশের ভাষা। সেই প্রধান মাধ্যমেই যেখানে গলদ, সেখানে এই মেলা-উৎসব-পার্বণ দিয়ে কোনোভাবে আমাদের প্রজন্মকে উৎসাহিত করা সম্ভব নয় বলে আমার বিশ্বাস।
আমরা অভিভাবকেরা হয়তো ভুলে গেছি, অতিরিক্ত ভাষা জানা একটি অতিরিক্ত যোগ্যতার পর্যায়ে পড়ে। এ দেশে যখন বিভিন্ন চাকরিতে আবেদন করা হয়, বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো পদে, তখন ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানা অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে গণ্য করা হয়। তাছাড়া অনেকেই হিন্দি/উর্দু ভাষার সঙ্গে পরিচিত, বাসায় টিভি চ্যানেল থাকার সুবাদে।
প্রতিবার মহান ভাষা দিবস এলে আমরা অনেক আবেগমিশ্রিত কথা বলি। আসুন, সেই কথাগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করি। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের সন্তানেরা দুই পরিবেশে বড় হচ্ছে, ঘর থেকে বেরোলেই তার সামনে আলাদা জগৎ। আমাদের কাজ হবে এ দুই ভুবনের মাঝে সুন্দর এক সেতুবন্ধ রচনা করা, যাতে করে সে অনায়াসে চলাচল করতে পারে। কোনোভাবেই যেন আরোপিত মনে না করে, দুই ভুবনে তাদের বিচরণ যেন হয় স্বতঃস্ফ‚র্ত। সবাই যদি ওয়াদা করি, আমরা সন্তানদের সঙ্গে বাসায় শুদ্ধ বাংলায় কথা বলব, ঘরের পরিবেশ হবে পুরোপুরি বাংলাদেশি, ঘরটাকে বানিয়ে ফেলব একখণ্ড বাংলাদেশ এবং সেই সঙ্গে সন্তানদের প্রচুর সময় দেব, তবেই আমাদের এসব মেলা, উৎসব উদযাপন, সাহিত্যচর্চা করা হবে সার্থক।……………….মামুন জামিল।